ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

পেকুয়ায় ‘স্কয়ার ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরী’র নামে অনুমোদনহীন ক্লিনিকের গলাকাটা বাণিজ্য

চকরিয়া অফিস :
কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র পেকুয়া আলহাজ কবির আহমদ চৌধুরী বাজারে একটি ভবন ভাড়া নিয়ে ‘পেকুয়া স্কয়ার ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরীর নামে’ অনুমোদনহীন ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ গলাকাটা বানিজ্য শুরু করেছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। নিয়মানুযায়ী সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছ থেকে ক্লিনিকের লাইসেন্স গ্রহণ করে ক্লিনিকের কার্যক্রম চালানোর সুস্পষ্ট বিধি-বিধান থাকলেও পেকুয়া ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরীর ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম। পেকুয়া উপজেলার রাজাখালীর বাসিন্দা মরহুম আবুল কাসেমের পুত্র ডাক্তার মো. আতিকুর রহমানের নেতৃত্বে আরো বেশ কিছু লোক গত বছরের ৮ মে পেকুয়া বাজারের পূর্ব পার্শ্বে একটি ভবনের নিচতলা ভাড়া নিয়ে সরকারী চিকিৎসকদের এনে রমরমা বানিজ্য চালাচ্ছেন বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন। সরেজমিনে ওই ক্লিনিকে গিয়ে গলাকাটা বানিজ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। ওই ক্লিনিকে এক্সরে মেশিন স্থাপন করা হলেও সরকারের আণবিক শক্তি কমিশন থেকে লাইসেন্স নেয়া হয়নি। অথচ আনবিক শক্তি কমিশনের কাছ থেকে অনুমোদন ব্যতিত এক্সরে মেশিন বসানোর নিয়ম নেই। এমনকি পেকুয়া উপজেলার সাত ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের রোগীদের আকৃষ্ট করতে পেকুয়া স্কয়ার ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরী কর্তৃপক্ষ ব্যাপক পোষ্টারিং, বিলবোর্ড ও মাইকিং করে রমরমা প্রচারণা চালাচ্ছে। আর এতে সাধারান রোগীরা প্রতিনিয়তই ওই অনুমোদনহীন ক্লিনিকে ভীড় জমাচ্ছে। এরপর সেখানকার ভাড়াটে চিকিৎসকরা রোগীদের প্রেসক্রিপসনে একাধিক প্যাথলজি পরীক্ষা লিখে দেন। এসব প্যাথলজী পরীক্ষাও স্কায়ার ক্লিনিকের প্যাথলজী থেকে করতে হয়। এসময় নিয়মের বাইরে রোগীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে সহজ সরল রোগীদের জিম্মি করে পেকুয়ার স্কয়ার কর্তৃপক্ষ গলাকাটা বানিজ্য চালালেও স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ ‘রহস্যজনক কারণে’ তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন।
পেকুয়া উপজেলার সাত ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের রোগী ও সাধারন লোকজনকে আকৃষ্ট করকে অনুমোদনহীন ওই ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ দালালদের মাধ্যমে রং বেরংয়ের কথিত লিপলেট প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিলি করা হচ্ছে। এসব লিপলেটে উল্লেখ করা হয়েছে, দ্রুত ও মান সম্পন্ন চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে, সেবার মান আরও একধাপ এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে স্বল্প ব্যয়ে উন্নত চিকিৎসা সেবা সাধারন জনগনের দৌরগোড়ায় পৌঁছে দিতে অত্যাধুনিক সুযোগ সম্বলিত পেকুয়া স্কয়ার ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরী ২০১৫ সালের ৮ মে  থেকে কার্যক্রম শুরু করেছে। এসব লিপলেটে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, বিশেষজ্ঞ চেম্বারসহ সব ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা, ডিজিটাল এক্সরে, ডেন্টাল এক্সে পোটেবল এক্সরেসহ ইত্যাদি ইত্যাদি… সেবা ওই ক্লিনিকে দেওয়া হয়। ল্যাবের অনুমোদন নিয়ে এখন পুরোদমে ক্লিনিকের কার্যক্রম শুরু করেছে স্কয়ার কর্তৃপক্ষ। সরেজমিনে দেখা গেছে, ডা: রুবেল শাহাদাত নামের এক চিকিৎসক ওই ক্লিনিকে ভর্তি করা রোগীদের চিকিৎসা কার্যাক্রম তদারকী করছেন। ইতিমধ্যেই চিকিৎসকদের চেম্বার ও ওই অনুমোদনহীন ক্লিনিকে একাধিক সিট বসিয়ে রোগী ভর্তি অবৈধভাবে চিকিৎসা সেবা শুরু করেছে। ওই ক্লিনিক অনুমোদনহীন ক্লিনিকে যে সব সরকারী চিকিৎসক চেম্বার খুলে গলাকাটা বানিজ্য শুরু করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছে, চমেকের মেডিকেল অফিসার ডা: ইমরুল কায়সার, পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা: রেজাউল হাসান, কুতুবদিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা: মো. জয়নাল আবেদীনসহ আরো অনেকেই। এসব চিকিৎসকরা অনুমোদন ক্লিনিক অবগত হয়েও টাকার লোভে প্রতিনিয়তই প্রাইভেট চেম্বার খুলে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিনে ওই অনুমোদনহীন পেকুয়া স্কয়ার ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরীতে গিয়ে দেখা গেছে, একটি ভবনের নিচতলার পুরো ফ্লোর ভাড়া নিয়ে কয়েকটি কক্ষে এক্সরে মেশিন, নানা ধরনের দামী প্যাথলজী সরঞ্জাম, চিকিৎসকদের চেম্বার, চিকিৎসকদের প্রতিটি চেম্বারে একটি করে সিটও বসানো হয়েছে। আর ক্লিনিকের সামনে সু-বিশাল ওয়েটিং রুমও সাজানো হয়েছে। সেখানে মহিলাসহ ৩ জন রিসিপসনিষ্ট দায়িত্ব পালন করছেন। এসময় ওই অনুমোদনহীন ক্লিনিকের চিকিৎসকদের চেম্বারে পেকুয়া সরকারী হাসপাতালের একজন ডাক্তার রোগীও দেখছেন। আর চিকিৎসকরা রোগীদের প্রেসক্রিপশনের পাশাপাশি ও ক্লিনিক থেকে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্যও বলছেন। এভাবে প্রতিনিয়তই পেকুয়া উপজেলার সাত ইউনিয়নের রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই অনুমোদনহীন ক্লিনিকে কিছু সরকারী চিকিৎসক প্রাইভেট চেম্বার খুলে গলাকাটা বানিজ্য ও শুরু করেছে। পেকুয়ার বারবাকিয়া ইউনিয়নের সবজিবন পাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও সরকারী চিকিৎসক জামায়াত-শিবিরপন্থী ডাক্তার আবদুর রাজ্জাক প্রতি বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার চেম্বার করেন। অভিযোগ রয়েছে, পেকুয়ায় জামায়াত-শিবিরের সাংগঠনিক কর্মকান্ডের পিছনে ওই সরকারী চিকিৎসক আবদুর রাজ্জাক মোটা অংকের অর্থ অনুদান প্রদান করে। দীর্ঘদিন ধরে ডাক্তার রাজ্জাক পেকুয়া বাজারের পান বাজার সড়কে অবস্থিত জামায়াত শিবির পরিচালিত প্যান ইসলামিক হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার হিসেবে চাকুরীও করেছিল। তার স্ত্রী ডাক্তার রায়হানা বেগমও প্যান ইসলামিক হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিল। উল্লেখ্য যে, ডা: আবদুর রাজ্জাক ছাত্রাবস্থায়ও জাময়াত-শিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল। তার পুরো পরিবারই জামায়াত-শিবিরের অনুসারী।
তবে পেকুয়া স্কয়ার ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরীর পরিচালক এম শাহাজাহান দাবী করেছেন, তারা শুধুমাত্র রোগীদের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। এখানে ক্লিনিকের নামে কোন ধরনের চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছেনা। তবে তক্লিনিকের কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনও করা হয়েছে।
পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপেক্সের ভারপ্রাপ্ত টিএইচও ডা: মো. মুজিবুর রহমান এ ব্যাপারে জানান, ওই ক্লিনিকে শুধুমাত্র ল্যাবরেটরীর অনুমোদন রয়েছে। ক্লিনিকের অনুমোদন নেই। কোন প্রকার অনুমতি গ্রহণ না করেই পেকুয়া স্কয়ার অবৈধভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে। তিনি এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়ে উর্দ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অবগত করবেন বলে জানিয়েছেন।
কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন ডা: পুচনুর সাথে এ ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, পেকুয়া স্কয়ার ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরী নামে কোন ক্লিনিকের অনুমোদন নেই। তবে ওখানে ল্যাবরেটরীর অনুমোদন রয়েছে। ল্যাবের অনুমোদন নিয়ে ক্লিনিকের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন না উল্লেখ করে সিভিল সার্জন আরো বলেন ‘শিগগিরই এ ব্যাপারে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। চিকিৎসা সেবা নিয়ে কোন ধরনের প্রতারণা ছাড় দেওয়া হবেনা।

পাঠকের মতামত: